খুলনা, বাংলাদেশ | ২৯শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১২ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  ভারতের আহমেদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান বিধ্বস্ত ২৪২ আরোহীর কেউ বেঁচে নেই, বিমানটিতে ছিলেন ২ পাইলট, ১০ স্ক্রু, ১৬৯ ভারতীয়, ৫৩ ব্রিটিশ, ৭ পর্তুগিজ ও একজন কানাডিয়ান
  ভারতে বিমান দুর্ঘটনা : নরেন্দ্র মোদিকে প্রধান উপদেষ্টার শোক বার্তা

একটি বটবৃক্ষের আত্মকাহিনী

মো: আরাফাত হোসেন

মাঠের ঠিক মাঝখানে বললে ভুল হবে তবে প্রায় মাঝামাঝিই বটবৃক্ষটির অবস্থান। মাঠে ফসল না থাকলেও বটবৃক্ষটি ধূ ধূ মরুভূমির মাঝে বহাল তবিয়তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়। বটবৃক্ষটির উৎপত্তি সম্পর্কে কিছু না জানা গেলেও এটি যুগ যুগ ধরে এলাকার ঐতিহ্যের সাক্ষী বহন করে চলেছে। বাপ-দাদা মারফত বৃক্ষটি সম্পর্কে নানা উপকথা, রূপকথা শুনতে পাওয়া যায়। যুদ্ধের শেষের দিকে একদিন নাকি এই বৃক্ষটির নিচে এক বুড়িকে মরে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। বুড়িটি কখন, কোথা থেকে এখানে এসেছিল সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। এমনিই সব রোমাঞ্চকর ঘটনা আছে এই বটবৃক্ষকে কেন্দ্র করে।

বটবৃক্ষটির শাখা-প্রশাখাগুলি অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সৃষ্টি করেছে। বৃক্ষের পাতাগুলো সুকেশিনীর কেশগুচ্ছ থেকেও উজ্জ্বল। বসন্তের হাওয়া যখন বইতে শুরু করে তখন পাতাগুলো সুখের সাগরে দোদুল্যমান পক্ষীর ন্যায় দুলতে থাকে। বটবৃক্ষের প্রকাণ্ড গুঁড়িটি মাঠের বুক চিরে গেঁথে আছে কত শত শতাব্দী। বৃক্ষের শাখা-প্রশাখাগুলোতে নানা ধরনের পাখিরা বসবাস করে আসছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। পাখিগুলো বৃক্ষটিকে আপন করে নিয়েছে। বৃক্ষটির নিচে বিদ্যমান ঝোপঝাড় আপন প্রতিবেশীর ন্যায় অবস্থান করছে যুগ যুগ ধরে।

গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরমে যখন মাঠে কৃষকেরা কাজ করে তখন বটবৃক্ষটি হয়ে ওঠে কৃষকদের বিশ্রামের আশ্রয়স্থল। আশপাশের পুরো এলাকার মধ্যে বটবৃক্ষটিই একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে মাঠের মাঝে একচ্ছত্র আধিপত্য বিরাজ করছে। পাখিরা এই বটবৃক্ষটিকে শান্তির আবাস মনে করে। বৃক্ষটিও যেন এই পাখিগুলোকে নিজের পরিবারের সদস্য মনে করে। গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরমে ছায়া দিয়ে, পক্ষীকূলের আবাসস্থল হয়ে বৃক্ষটি সুখানুভব করে।পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ এবং পাতার সাঁ সাঁ শব্দ মনে এক অন্যরকম দোলা লাগানো ভাব এনে দেয়। অন্যান্য প্রাণীদের উপকার করাই যেন বটবৃক্ষটির একমাত্র ধর্ম। বৃক্ষটির উদ্দেশ্যই হয়ে উঠেছে পরোপকার।

অতঃপর সেই দিন এলো,
মাতব্বর মোকলেস গাজী লোক ভালো না। এলাকার মাতব্বর হওয়ার সুবাদে সে অনেক অবৈধ কাজ করে বেড়ায়। সে এলাকার ব্যক্তিমালিকানাধীন নয় এমন জিনিস সব এক এক করে গ্রাস করতে থাকতে। এক পর্যায়ে তার চোখ পড়ে এই বটবৃক্ষটির উপর। সে এই বটবৃক্ষটি গ্রাস করার কুমতলব করে। সে এলাকাবাসীদের ডেকে কৌশলে তার কুমতলবের কথা বলে। এলাকার লোকজন প্রথমে মোকলেস কাজীর দুরভিসন্ধি বুঝতে না পারায় বটবৃক্ষটিকে কেটে ফেলতে রাজি হয়।
মোকলেস কাজী বলে, “ভাইসব, এই গাছডা অনেকদিন ধরি আমাগীর মাঠের ফসল নষ্ট কত্তিছে, তাই আমরা গাছডা কেটি ফ্যালবো, আপনারা কি কন? ”
এলাকাবাসী সবাই ‘ঠিক ঠিক’ বলে সম্মতি দেয়।
এলাকাবাসী সে সময় মোকলেস কাজীর কুমতলব ধরতে পারেনি। সে তো মূলত বৃক্ষটি কেটে বিক্রি করতে চায়।
সুতারং মোকলেস আবার বলে, ” ঠিক আছ ভাইসব, কালকি এ গাছডা কেটি ফ্যালা হবে।”

এলাকার রহিম মিয়ার বড় ছেলে ‘মহিন’ কলেজে পড়ে। সে বাড়ি এসে ভাত খাওয়ার সময় তার মা তাহেরা বেগমের কাছ থেকে বটবৃক্ষটি কেটে ফেলার কথা জানতে পারে। এটা জানতে পেরে যেন মহিন আকাশ থেকে পড়ে।
সে বলে, ” এ গাছডা তো আমরা জন্মের তে দেখতি, এ গাছ এখন কেটি ফেলতি হবে কেন? এত বছর কি ফসল নষ্ট করিনি?”
তার মা তাহেরা বলে, ” কি জানি বাপ, কতি পারিনি তুগির এসব কাহিনী।”

মহিন এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বলে তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু কেউ মোকসেল কাজীর বিরুদ্ধাচারণ করতে চায় না। সবাই বলে মোকলেস কাজী লোক ভালো না। সে যদি পেছনে লাগে তো আমরা শেষ হয়ে যাবো।

মহিন সারাদিন চেষ্টা করেও কোনো সমাধানে আসতে পারেনি। অতঃপর বটবৃক্ষটি কর্তন করার সময় আগত। মোকলেস কাজী কায়েকজন কাঠুরেকে নিয়ে বৃক্ষের কাছে পৌঁছে যায়। এই দেখাদেখি এলাকার প্রায় সবাই মাঠে এসে উপস্থিত হয়। সবার মাঝে একটি অস্বস্তি কাজ করতে থাকে কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারে না মোকলেস কাজীর জন্য।

মহিনও অন্যদের মতো ‘বটবৃক্ষ কর্তন’ দেখতে উপস্থিত হয়।
এরপর মোকলেস কাজী এক কাঠুরেকে আদেশ দেয়, ” এই মজিদ, গাছ কাটা শুরু করি দে এবার।”
মজিদ কাঠুরে আদেশ পেয়ে কুঠার নিয়ে গাছে কোপ দেবে এমন সময় মহিন বলে ওঠে, ” থামো, অনেক হয়িছে নাটক, থামো।”
মোকলেস কাজী বলে, ” কিরে মহিন, তুই মাথতি বললি কেন?”
মহিন বলে,” এ গাছ আমি কাটতি দোবো না।”
মোকলেস কাজী বলে,” তোর তো সাহস কম না, আমার সামনে তুই বলতিছিস গাছ কাটতি দিবিনি? জানিস আমি তোর কি হাল করতি পারি? মেরি পিঠির চামড়া তুলি দোবো একদম। বের হ এখান তে।”
মহিন বলে,” আপনি এলাকার মাতব্বর হয়ি এরাম কথা বলতি পারেন না। আর আপনি এ গাছ কাটতিছেন কেন? এ গাছটা আমাগির বাপ-দাদাগের আমলের তে এখানে রয়িছে। গরমের মধ্যি কাজ করি জনেরা এ জাগায় এসি জিরোয়। গাছে পাখিগুলো কতবছর ধরি বাস করি এসতিছে। সব আপনি ধ্বংস করি দিতে চাচ্ছেন কেন?”
মোকলেস কাজী বলে, ” তুই ছোট মানুষ, তুই কি বুঝিস? আমি একা এ গাছ কাটতি আসিনি, সবার তে মত নে তাই কাটতি আইছি। এ গাছের জন্যি আমাগির মাঠের কতডা ফসল নষ্ট হতি তুই বুঝিস?”
মহিন বলে, ” আপনি তো আচ্ছা ধড়িবাজ লোক, বটগাছের জন্যি ফসল নষ্ট হতি কোন জাগায়? আশপাশের জমিতে এট্টু ছায়া পড়ে, তা সারাদিন পড়ে না, সকালবিলা পড়লি বিকেলে আর পড়ে না। আর বটগাছ তো সরকারি জমিতি রয়িছে। মূল কথা হলু গে, এই বটগাছ কেটি আপনি পকেট ভর্তি করতি চান তাই নানা টালবাহানা করতি লেগিছেন।”
এলাকাবাসী, “এ তো ভালো কুথা কইছাও, এ কুথা তো আমরা ভেবি দেখিনি আগে! মাতব্বর তুমার মনে মনে এই ছেল তালি? আমরা এ গাছ আর কাটতি দোবো না তুমার। ”
মোকলেস রেগে লাল হয়ে যায়। আর বলে, “ঠিক আছ, তুমরা যা ভালো মনে করো তাই করো, আমি গিলাম, এই মজিদ কই তুরা আয় গাছ কেটতি হবে না আর।”

এই বলে মোকলেস কাজী বটবৃক্ষটি না কেটেই চলে গেল। তার কুমতলব এবারের মতো মহিনের জন্য সফল হলো না। তাই মহিনের প্রতি একটু চটেই রইলো মোকলেস কাজী।

সবাই এক এক করে মাঠ থেকে বাড়ির দিকে রওনা হলো। শুধু মাঠে থাকলো মহিন এবং বটবৃক্ষটি। একে অপরের মুখোমুখি, দুইটি প্রাণী একে অপরকে দেখছে, মুগ্ধ হয়ে দেখছে, কারোর মাঝে কোনো অস্বস্তি নেই। চারিদিকে বিস্তর নিরবতা। বটবৃক্ষটি যেন সেই নিরবতার মধ্যেই মহিনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলো।

একসময় মহিনও বাড়ির পথে রওনা হলো। বটবৃক্ষটিরও মহিনের সাথে হেঁটে চলে যেতে ইচ্ছা হলো কিন্তু যেতে পারলো না। এই মাঠের বুক চিরে তার প্রকান্ড শিকড়টি যে বহুবছর ধরে গেঁথে আছে।

“ওদের পাড়ার মহিনীর মা ‘মর্জিনা খাতুন’ ঠিক ঐ বটবৃক্ষের প্রতিরূপ!”

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!